রাস্তায়, পাড়ার দোকানে বা বাজারে যেকজন লোক দেখা যায়, একটু ভালো করে লক্ষ করলে তাদের মুখে একটা অদ্ভুত আলোচনা প্রত্যক্ষ করা যাবে আর সেটা হোলো একটা অদ্ভুত থিওরি যেটা এতো মশলাদার যে এই টিভি সিরিয়ালহীনতার মার্কেটে মানুষকে নতুন আড্ডার বিষয় বস্তু জোগাতে সেটা একাই একশো, আর থিওরিটা হোলো – করোনা আসলে টেস্ট ল্যাবে তৈরী করা চৈনিক ভাইরাস, যদিও অনেক আধুনিক দেশ এবিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি বানিয়েছে এবং সব বিষয়ে নাক গলানো ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ তাঁর মধ্যে অন্যতম, তারা সিআইএ কে নিয়োগ করেছে এটা দেখার জন্য কিন্তু এখনো অব্দি এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যার থেকে এটা ধরা যায় যে চৈনিক ল্যাব যেটা উহানের বাজারের কাছে অবস্থিত সেখানথেকেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি।
যাই হোক এটাতো গেলো করোনার উৎপত্তির ইতিকথা, সময় বলবে যে সেটা মানুষের তৈরী নাকি প্রকৃতির দান।
কিন্তু এখন যে ঘটনার কথা বলবো, সেটা মানুষের ভুলে হওয়া পৃথিবীর অন্যতম পারমাণবিক দুর্ঘটনা। ইতিহাস খ্যাত চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা।
সালটা ১৯৭০ এর ফেব্রুয়ারী মাস। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া অধুনা ইউক্রেন – বেলারুশ সীমান্তে স্থাপনা করে প্রিপায়াত শহর। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রিপায়াত হবে একটি নিউক্লিয়ার শহর আর তাঁর পাশেই স্থাপনা হবে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। যাতে চেরনোবিলে কাজ করা সকল কর্মচারী প্রিপায়াতে থাকতে পারেন এবং আধুনিক শহরের সকল সুযোগ সুবিধা পান সেজন্য প্রিপায়াতকে ঢেলে সাজানো হয়। হাসপাতাল, কমিউনিটি হল, বড়ো বড়ো ফ্ল্যাট, স্কুল, কলেজ, সুইমিং পুল সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালীন সোভিয়েতের কাছে প্রিপায়াত ছিল গর্বের বিষয়। আর হবে নাই বা কেন, যেকোনো ইউরোপের শহরকে একা প্রিপায়াত টেক্কা দিতে পারতো এবং হেলায় হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখতো।
সমস্ত কিছু ভালোই চলছিল। প্রিপায়াত শহরে থাকছিলেন প্রায় ৪৯৩৬০ জন। হঠাৎ করে এলো সেই অভিশপ্ত রাত।
২৬শে এপ্রিল, ১৯৮৬। ৪ নম্বর নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর হঠাৎ করে ফেটে যায়, উন্মুক্ত হয়ে যায় রিয়েক্টর কোর। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় বায়বীয় পদার্থ। ফাঁকা করা হয় প্রিপায়াত শহরকে। তেজস্ক্রিয়তার কারণে এখনো প্রিপায়াত সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা গোটা শহর যেখানে প্রায় ৩০ বছর আগে থাকতো প্রায় ৫০ হাজার মানুষ, সেই শহরকে এখন গ্রাস করেছে জঙ্গল। পৃথিবীর সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় স্থান হিসেবে এখনো আসে প্রিপায়াতের নাম। কিন্তু কেমন করে ঘটলো এই ঘটনা, দোষটাই বা কার, আর কি হোলো এই ঘটনার পর , এবার দেখে নেবো এগুলো।
ছবিতে ৪ নম্বর রিয়েক্টর
কিভাবে ঘটলো?
তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় আরবিএমকে নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর ব্যবহার করা হোতো। এই ধরণের রিয়াক্টর সোভিয়েতরা সুরক্ষিত বলেই মনে করতো। দুর্ঘটনা ঘটে এই রিএক্টরে একটি টেস্ট চলাকালীন। বৈদ্যুতিক পাওয়ার আউটএজ হলে রিয়েক্টর সুরক্ষিত কিভাবে রাখাযাবে সেটাই ছিল এই টেস্ট করার কারণ।
পাওয়ার আউটএইজ হলে ব্যাকআপ জেনারেটার না চলা অব্দি রিয়াক্টর ঠান্ডা রাখার কুলিং ওয়াটার সরবরাহ করাই ছিল এই টেস্টের মূল লক্ষ। পাওয়ার আউটএইজ হলে ব্যাকআপ জেনারেটার চলতে সময় লাগতো এক মিনিট, শুনতে খুব অল্প সময় হলেও এই একমিনিটে উৎপন্ন হওয়া তাপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে গোটা রেয়াক্টরটাই। তবে সোভিয়েতদের দাবি ছিল এই একমিনিটে রেয়াক্টরের টারবাইনে যেটুকু এনার্জি অবশিষ্ট থাকবে সেটা দিয়েই চালানো যাবে রিয়াক্টর ঠান্ডা করার প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ।
কিন্তু ১৯৮৬ র ২৬শে এপ্রিল কোনো কিছুই পরিকল্পনা মাফিক কাজ করেনা। রিয়েক্টারের গলদ ডিসাইন এবং হঠাৎ করে রিয়েক্টর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উৎপন্ন হওয়া প্রচন্ড তাপ রিয়াক্টরের কোর যেটা গ্রাফাইট দিয়ে তৈরী হোতো সেটা গলিয়ে দেয় এবং রিয়েক্টার ঠান্ডা করার জল সেই তাপে বাষ্পীভূত হয়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। পৃথিবীর কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রিয়াকটারের তেজস্ক্রিয় কোর।
৯ দিন সময় লাগে এই কোরকে ঢাকতে, আর এই ৯ দিন ধরে চলতে থাকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। সমগ্র প্রিপায়াত এবং তার আশেপাশের এলাকা থেকে সরানো হয় প্রায় 1 লক্ষ মানুষ। পুরো প্রিপায়াত খালি করা হয়। প্রায় ১৩৬ জন অগ্নিনির্বাপনকারীকে ভর্তি করা হয় কাছের হাসপাতালগুলোতে কারণ তীব্র তেজস্ক্রিয়তায় তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস খুলে খুলে আসছিলো।
৯ দিন ধরে চলে অনিয়ন্ত্রিত তেজস্ক্রিয় বিচ্ছুরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউরোপের বেশ কিছু এলাকা। সোভিয়েত সরকার মতে মৃত্যু সংখ্যা ১০০র কাছাকাছি হলেও বিভিন্ন সময় হওয়া সার্ভেতে এই সংখ্যা ৪০০০ থেকে ১০০০০ বলা হয়ে থাকে।
কার দোষ?
রিয়েক্টরএর ডিসাইনের গলদ মানতে রাজি ছিল না সোভিয়েত এবং তাদের তৎকালীন সরকার, এবং ডিসাইন গলদ থাকার জন্য সমগ্র টেস্টিং প্রক্রিয়ার ম্যানুয়াল বইটিও যে গলদে ভরা সেটাও তারা মানেননি, তাই পুরো দোষ দেওয়া হয় যারা টেস্টিং করেছিলেন তাদের ইনচার্জ দিয়াতলভ এর ওপর।
এই হোলো সহজ ভাষায় সে অভিশপ্ত রাতের কাহিনী, আসল ছবিটা অবশ্যই ছিল এর থেকে হাজার গুনে বীভৎস।
আবার আরেকটা ২৬শে এপ্রিল এসে গেলো, ঘটনার পর কেটে গেছে ৩৪ বছর, কিন্তু প্রিপায়াত এখনো জঙ্গলাকীর্ণ, বসবাসের অযোগ্য, সেখানের আবহাওয়ায় তেজস্ক্রিয়তা এখনো বর্তমান।
কার ভুল এটা প্রশ্ন হওয়া উচিৎ নয়, প্রশ্ন হওয়া উচিৎ মিথ্যে কোনটা, কারণ সত্য জানলে কার ভুল সেটা খোঁজার দরকার হয়না। ঘটনার পর থেকেই সোভিয়েত সরকার তথ্য গোপন করে, বলা হয় বিকিরণের মাত্রা মাত্র ৩ রন্টজেন, যেটা একটা এক্সরে মেশিনের থেকেও কম কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা যখন বলেন বিকিরণের মাত্রা ১৫০০০ রন্টজেন যেটা হিরোশিমার পরমাণু বোম্ব এর থেকেও দুগুণ শক্তিশালী তখন তাদের তথ্য গোপন রাখার জন্য বলা হয়, কারণ তথ্য পৃথিবী জানলে সোভিয়েত ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
এই পুরো ঘটনার তদন্তে থাকা প্রফেসর ভ্যালেরি লেগসভ ১৯৮৮ সালে আত্মহত্যা করেন কারণ সত্য গোপন করা তাঁর মননের বিরুদ্ধে ছিল। তাঁর মতে এই দূর্ঘটনার থেকে বেশি মানুষ মারা গেছিলো তথ্য গোপনের জন্য।
Very informative and we’ll structured document. Well done Arindam.