জংলী_হাওয়া

জংলী_হাওয়া

সাহিত্যিক – অঙ্গন দাস

দু’চোখের সামনে গহন শালের জঙ্গল। দূরে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে সবুজ পাহাড়। মুণ্ডাদের দেওয়া নাম ‘জিলিংবুরু’। অনবরত চিঁচিঁ শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। বাঁহাতে তিরতির করে বইছে নদী। না ঠিক নদী নয়, জলধারা। সেই সরু জল পথে পিঠ পেতে শুয়ে রয়েছে ছোট বড় কত কত নুড়ি পাথর। তারা সবাই সংগ্রামী; ঠিক এখানকার মানুষগুলোর মত। জলধারাটি ঢুকে গেছে জঙ্গলে।
অনিমিখের খুব ইচ্ছে করল, সেও ওই জঙ্গলটাতে ঢুকবে। দু’পা সেদিকে এগোতেই পেছন থেকে ডাক এল – “দাদা!” অনিমিখ ফিরে তাকাল। সুভাষ হাত নেড়ে ডাকছে। তার উঁচু গলাও শোনা গেল “ওদিকে যাবেন না দাদা, জায়গাটা ভাল না। চলে আসুন, আমরা ফিরে যাই এবার। সন্ধের মুখে এখানে থাকা বিপজ্জনক।” অনিমিখ দূর থেকে সুভাষের সতর্কবার্তার সাথে তার চিন্তিত মুখখানা লক্ষ্য করল।
সুভাষ ছেলেটা মন্দ নয়, দায়িত্ববান ও যত্নশীল। এই অঞ্চলের রুক্ষ্ম সূক্ষ্ম মাটির মত নয় বরং উল্টোই, অত্যন্ত নরম মনের সে। আজকের দুপুর থেকে ঘণ্টা খানেক সঙ্গী হয়েছে সে। এইটুকু সময়ে কেউ এত আপন হয়ে উঠতে পারে তা সুভাষকে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। সুভাষ ছিল বলেই এমন একটি সুন্দর মূহুর্ত কাটাচ্ছে সে এখন। নতুবা হোটেলের ঘরে বসে একঘেয়ামি সময় পের করতে হত। আজ ভোরেই রাঁচি শহরে পৌঁছেছে অনিমিখ। দিনভর মিটিং সেরে আগামী কাল দুপুরে ট্রেন ধরবে। সেই মত ট্রেনের টিকিটও রয়েছে তার। কিন্তু রাঁচিতে পা রাখা মাত্রই অফিস জানায় মিটিং বাতিল হয়েছে। কি করবে সে এখন? রাঁচি শহর তার আগেই ঘোরা হয়েছে। ফিরে যাবে? কিন্তু ছয় সাত ঘন্টার রাস্তা রিজার্ভেশন ছাড়া এত ঝক্কি সে নেবে না। যাই হোক কিছু একটা সে করবে। এখন হোটেলে যাওয়া যাক। এই ভেবে রাস্তায় নেমে ভাড়ার গাড়ির খোঁজ শুরু করল। জুটে গেল সুভাষ। সুভাষ তাকে প্রথমে নিয়ে গেল তার বুকড্ থাকা হোটেলে। সেখানে থেকেই স্নান খাওয়া সেরে সোজা এই ‘পঞ্চঘঘ’ এ। অনিমিখ এই যায়গার নাম আগে কখনো শোনেনি। সুভাষই বলল, “দাদা, একটা সুন্দর যায়গা আছে। চলুন, সত্যি ভাল লাগবে।” সুভাষের উপর বিশ্বাস রেখে সে এসেছে এখানে।
হঠাৎ করে দূরের পাহাড়টা নিজের কোলে টেনে নিল সূর্যকে। আকাশের আলো নিভে এল। জঙ্গলের কালো ছায়া এসে পড়ল ভগ্নপ্রায় সাঁকোটির উপর যেখানে অনিমিখ দাঁড়িয়ে এখন। এক প্রহরী দাদা হুইশেল ফুঁকতে ফুঁকতে একটি ছোট্ট চালাঘর থেকে বেরিয়ে এল। অনিমিখ ফিরে এসে সুভাষকে জিজ্ঞাসা করল, “ওই পাহাড়ে ঘর বাড়ি আছে?”
সুভাষ বলল, “না দাদা। ওই পাহাড়ে কোন বসতি নেই। তবে পাহাড়ের নীচে এই জঙ্গলের শেষ সীমায় দুটো ছোট্ট গাঁ আছে। ‘সরগিলা’ ও ‘পাঠপুর’।”
অনিমিখ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “ও। আচ্ছা, এত সুন্দর একটা জায়গা কিন্তু এত নির্জন কেন? যেন মনে হয় গিলতে আসছে।”
“এখন তো তাও কেউ কেউ আসে। দুই তিন বছর আগে এখানে বেড়াল কুকুর পর্যন্ত আসতে পারত না।”
“কেন?”
“সে অনেক কথা। এখানে এসব বলা যাবে না। এখানকার বাতাসও সুবিধের নয়, ওদের ঈশারায় চলাচল করে। চলুন গাড়িতে উঠে বসুন। যেতে যেতে সব বলছি।”
ফেরার পথ ধরল দু’জন। এই যায়গাটা বড় রাস্তা থেকে অনেক নীচে। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বিকেলে নেমে এসেছিল অনিমিখ। এখন খাড়াই সিঁড়ি ধরে উঠতে হাঁফ ধরছে তার। সুভাষের অবশ্য এসব অভ্যেস। সে অনিমিখের হাত ধরে তাকে সাহায্য করল। সন্ধ্যের ধূষর রঙের মধ্যে সুভাষের ফোর্ডের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির রঙ সাদা হওয়ায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেটি। গাড়ির কাছাকাছি এসে মনটা খুব খারাপ লাগছে অনিমিখের। ফিরে যেতে হবে তাকে। তার ফিরতে ইচ্ছে করছে না এখন। ইচ্ছে করছে কয়েক বছর কাটিয়ে যায় সে এখানে। কিন্তু সময়ের টান বড়ই নিষ্ঠুর। সুভাষ গাড়িতে চেপে বসেছে। অনিমিখ একবার অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়া জঙ্গলের দিকে তাকাল।

(২)
জনশূন্য পথে গাড়ি ছুটল ফিরতি পথ ধরে। রি রি করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে আসছে গাড়ির মধ্যে সঙ্গে নিয়ে মিঠে গন্ধ। সুভাষ জিজ্ঞাসা করল, “দাদা, কাঁচগুলো তুলে দেবো?” শহুরে ঘেরাটোপে এমন হাওয়ার পরশ অনিমিখ কখনো পায়নি। চোখ জুড়িয়ে এল তার। সুখ জড়ানো গলায় সে বলল, “না থাক। হাওয়াটা বেশ আরাম দিচ্ছে। গন্ধটাও বেশ ভালো।”
“হ্যাঁ, জঙ্গলের নিজস্ব গন্ধ এটা। এই হাওয়া নেশার থেকে কোন অংশে কম নয়।”
“কই লাগছে না তো।” অনিমিখ বলল।
“লাগবে, লাগবে, টের পাওয়ার আগেই আপনি তলিয়ে যাবেন।”
“তোমার লাগে না?” অনিমিখ জানতে চাইলো।
“এখন লাগে না, অভ্যেস হয়ে গেছে।”
“একটা চা পেলে মন্দ হত না। রাস্তায় দোকান পেলে গাড়ি থামিও তো।” সুভাষ মাথা কাত করে সম্মতি জানাল।
গাড়ির গতি শ্লথ হল বড় রাস্তার মুখে এসে। অল্পসল্প দোকানদানি রয়েছে এখানে। যাওয়ার সময় তো কই সেভাবে চোখে পড়েনি! অন্ধকার পেরিয়ে হঠাৎ আলো পেলে চোখ বেশি করে টানে। বাঁ দিক ঘেঁষে গাড়ি থামিয়ে সুভাষ অনিমিখকে নামতে বলল। গাড়ি থেকে নামতেই চোখের সামনে দুটো খাওয়ার দোকান দেখল অনিমিখ। আশেপাশে টুকরোটাকরা জমায়েত। জায়গাটির নাম ‘ডুঁডরি’।
খাটিয়ার ওপর বসেছে অনিমিখ ও সুভাষ। আদিবাসী দম্পতি মহানন্দে দোকানটি চালাচ্ছে। তেলেভাজা ডাঁই হয়ে রয়েছে ঝুড়ির মধ্যে। খদ্দেরের আনাগোনা চোখে পড়ার মত। সুভাষ স্বভাষায় দম্পতিকে কিছু বলল। খানিক পরেই গোটাকতেক তেলেভাজা আর দুই ভাঁড় চা নিয়ে উপস্থিত হল মহিলা।
পেট শান্তি হতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। ‘ডুঁডরি’ ছাড়াতেই আবার শুরু হল জঙ্গল তবে গাড়ির আলোয় স্পষ্ট বোঝা যায় জঙ্গল ঘন নয়। মাঝেসাঝে এক দুটো ঘর। দিম্ দিম্ করে আলো জ্বলছে উঠোন গুলোতে; কেরোসিন বাতি। সপিং মল, রেস্টুরেন্টের রঙিন আলোতে উদ্ভাসিত সমাজ যদি না বোঝে, নিশীথ কাকে বলে? তারা দেখে যাক কালিমা কেমন করে এই গরীবের ভিটেতে জন্ম নেয়।
এই রাস্তা গিয়ে পৌঁছেছে ‘খুঁটি’ জেলা শহরে। প্রায় ত্রিশ কিমি পথ। সেখান থেকে ডানদিক ধরে যেতে হবে আরও বিশ কিমি মত রাঁচি। কিছুক্ষণ আগেই রাস্তায় দু’চারটে গাড়ির আনাগোনা ছিল, এখন পুরোপুরি নীরিবিলি। এত শান্ত! অনিমিখ পথের এমন শান্ত রূপ কখনো দেখেনি। সুভাষও কথাবার্তা থামিয়ে নিশ্চুপ। জংলী হাওয়া চোখে মুখে ঝাপটা মেরে শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
চোখটা সামান্য লেগে গিয়েছিল অনিমিখের। ঝাঁকুনি পেতেই চোখ খুলল তার। গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে, সুভাষ নাগাড়ে চেষ্টা চালাচ্ছে গাড়িটিকে পুনরায় চালু করতে। আর তাতেই ঝাঁকুনি লাগছে বেশ।
“কি হল সুভাষ?”
“বুঝতে পারছি না দাদা। ঠিকঠাকই তো চলছিল, হঠাৎ যে কি হল!”
অনিমিখ মোবাইলের স্ক্রিন অন করে দেখল সাতটা চল্লিশ। সুভাষ নেমে গিয়ে গাড়ির বনেট খুলল। অনিমিখও পা ছোঁয়াল মাটিতে।
গাড়ির বড় আলো দূরের গাছগাছালিতে গিয়ে পড়েছে, মনে হয় ওখানটায় রাস্তা বাঁক নিয়েছে অনেকখানি। দৃশ্য খুব একটা পরিষ্কার নয়, ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে রয়েছে চারিপাশ। বেশ চিন্তিত লাগছে অনিমিখকে। লম্বা শ্বাস ছেড়ে সিগারেট জ্বালাল সে এবার। সুভাষ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকে গেল গাড়ির মধ্যে। হেড লাইটের আলো কয়েকবার দমকে এক্কেবারে বন্ধ। সুভাষ চাবি ঘুরিয়ে চলেছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। যদিও গুর গুর করে ইঞ্জিনের শব্দ আসছিল সেটাও নেই।
“কী হল? ইঞ্জিনের শব্দ হচ্ছে না?” অনিমিখ জিজ্ঞাসা করল।
“না, হচ্ছে না!” হতাশ হয়ে বলল সুভাষ।
কথাটা শুনেই ঝাকুনি খেল অনিমিখ। “হচ্ছে না মানে? এই শুনশান জঙ্গল পথে বসে থাকবো?”
“তা কেন? একটু অপেক্ষা করুন। ওপরওয়ালা নিশ্চই একটা উপায় বাতলে দেবে।” বলেই পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল। “যা শালা! টাওয়ার নেই তো!”
অনিমিখও তার সর্বক্ষণের সাথী মোবাইলটির পর্দায় চোখ রাখল। না, তার ফোনও আউট অব কাভারেজ। সিগারেটের শেষাংশ টুসকি মেরে ফেলে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আর তোমার ওপরওয়ালা! সে তো সকাল থেকে আমার কাজে বেগড়া দিয়ে চলেছে। এই যে দেখ ফোনটাও এখন অকেজো করে রেখেছে।”
সন্ধ্যের পর এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল এক্কেবারে কমে আসে। কিন্তু আজ কেন একটি গাড়িরও দেখা মিলছে না? সময় পেরোল আরও ঘণ্টা খানেক। সুভাষকে এবার ভীষণ চিন্তিত লাগছে। সে পয়চারী দিতে শুরু করল।
মিনিট পাঁচেক বাদে চোখে এল এক চড়া আলো। সামনের মোড়ের ঝোপে এসে পড়েছে তার ছটা। দ্যুতি ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। নিশ্চই কোন গড়ি আসছে এদিকে। যেভাবেই হোক গাড়িটিকে থামিয়ে সাহায্য নিতে হবে। সুভাষ দৌড়ে গেল রাস্তার মোড়ের দিকে। অনিমিখও ছুটল সুভাষের পিছু পিছু।

(৩)
ক্রমশ এগিয়ে আসছে, কিন্তু বড়ই মন্থর। আলোর আবার এমনই তেজ যে, পিছনে থাকা বস্তুটিকে দেখা যাচ্ছে না। এগোতে এগোতে এসে থামল অনিমিখদের সামনে। না, কোন চাকা নয়, এক জোড়া পা। চোখের সামনে থেকে আলো সরতেই দেখা গেল তাকে। দেখা মাত্রই সুভাষ গড়গড় করে বলল বিপদের কথা। প্রত্যুত্তরে লোকটি কি যে বলল, অনিমিখ তা বুঝল না। সে সুভাষকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি বলছে লোকটা?”
সুভাষ জানাল, “আশে পাশে কোন গ্যারাজ নেই। সকাল না হলে কোন মিস্ত্রিও পাওয়া যাবে না।”
“বল কি! সারা রাত এখানে?”
“সে বন্দোবস্ত হয়েছে। কাছেপিঠেই ওনার বাড়ি। উনি আমাদের সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছেন।”
লোকটি হাতের ইশারায় তাদেরকে ডেকে একটু খানিক এগিয়েই সুভাষের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটির গা ঘেঁষে নেমে গেল জঙ্গলের দিকে। সুভাষ অনিমিখও পিছু নিল লোকটির। জঙ্গলের পথে দু’চার কদম এগোতেই টর্চের চড়া আলোতে জেগে উঠল একচালার একটি ঘর। বলা চলে রাস্তার একদম পাশেই। অন্ধকারের মধ্যে যা এতক্ষণ চোখে পড়েনি।
ভদ্রলোকের একার সংসার। মাটির মসৃণ দেওয়াল, খাপরি বসানো চালা। ভদ্রলোক লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিলেন। ভেতরকার দেওয়ালে ফুটে উঠল পরিপাটি আল্পনার কাজ। হ্যরিকেনের লালচে আলোয় ভদ্রলোকের মুখ দেখা গেল এবার। অশীতপর বৃদ্ধ তিনি। কুঁচকুঁচ চামড়ার মুখ। তামাটে রঙ। এই অঞ্চলের উপজাতিরা দেখতে যেমন হয় তেমনই। উপজাতি এই মানুষ গুলোকে দেখলে অনিমিখের মনে প্রশ্ন জাগে, এরা সবাই একই রকম দেখতে হয় কেন? একই উচ্চতা, এক রকমের চোখ, নাক, কপাল, ঠোঁট, গাল, চিবুক। সবার একই রকম। অনিমিখ তাকিয়ে রইল লোকটির মুখে। অনিমিখ মনে মনে ভাবল- ও ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? চোখের দৃষ্টি খুব একটা সুবিধের নয়। একটা চোখ বেশ খানিকটা লাল। অন্যটা একটু বড়। অনিমিখকে এক দৃষ্টিতে দেখেই চলেছে। পুরো শরীর শিরশিরিয়ে করে উঠল অনিমিখের। অপরিচিত যায়গা, অরন্যের পথও। সুভাষের সাথে পরিচয়ও কয়েক ঘন্টার। কিঞ্চিত ভয় করতে শুরু করেছে তার।
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ন’টা সবে। অথচ মনে হচ্ছে কত রাত’ই না হয়েছে। ছোট্ট ঘরের মধ্যে দুটি খাটিয়া পাতা রয়েছে। একটিতে সুভাষ ও অন্যটিতে অনিমিখ শরীর এলিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোক ফিসফিসিয়ে সুভাষকে কিছু একটা বললেন। কী বলল কানে কানে? কানে কানে বললোই বা কেন? জোরে বললেও অনিমিখ তো সে ভাষা বুঝত না। সুভাষ তেরচা ঘাড় ঘুরিয়ে আড় চোখে দেখে নিল অনিমিখকে। সুভাষের কপালে ওটা কী? কালো হয়ে রয়েছে যেন! আগে তো ছিল না! অনিমিখের চোখে চোখ পড়তে মৃদু হাসল সুভাষ।
অনিমিখ দেখল এর মধ্যেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক হাতে দুটো বাটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনিমিখ উঠে বসতেই তার হাতে একটি বাটি ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধের ঘাড় নাড়লেন তিনি।
“খেয়ে নিন দাদা, ঢেঁকী ছাটা মুড়ি অন্য কোথাও পাবেন না।” সুভাষ বলল। অনিমিখ দেখল মুড়ির সাথে চারটে বাতাসাও রয়েছে। অনিমিখ একমুঠ মুড়ি মুখে নিল।
“তুমি যা বলেছো সুভাষ, সত্যিই সুস্বাদু”।
“এবার জল টা খেয়ে দেখুন। কলজে টাণ্ডা হয়ে যাবে।” সুভাষ ঘটি ভরা জল অনিমিখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল।
সুভাষের কথা মত গলায় দিল সে। “আহ্, শান্তি নেমে এল শরীরে মনে।”
কিছুতেই ঘুম আসছে না অনিমিখের। চোখ বুজিয়ে শুয়ে শুয়ে ভেবে চলেছে সে – সেই প্রথম থেকে পোড়া পোড়া একটা গন্ধ নাকে লেগে রয়েছে তার। বৃদ্ধ লোকটি কোথায় গেল? সেই যে জল দিয়ে গেল। সুভাষ ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। সাড়াশব্দ নেই। মাঝে মাঝে শেয়াল ডাকছে। ডাক গুলো অদ্ভুত! শুনলেই বুক ফাঁকা হয়ে আসে। ওরা কী কোন সংকেত পাঠাচ্ছে? বাড়ির মাথায় ঝুপ করে কিছু একটা পড়ল! চোখ খুলে গেল অনিমিখের।
“কে? কে?” অনিমিখ দু’বার ডাক দিল। রেখে যাওয়া বৃদ্ধের লণ্ঠনের আলো নিভু নিভু। দৃশ্য খুবই আবছা। তার গলার আওয়াজে একটা ছায়া সদরের দিকে ছুটে গেল মনে হল। অনিমিখ দেখল, সুভাষ উপুড় হয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। একটা প্যাঁচা ডাকতে শুরু করল অদূরেই। ভীষন কর্কশ সেই রব। কাল প্যাঁচা কী?
অনিমিখ অনুভব করল তার জোরসে হিসু পেয়েছে। কিন্তু খাটিয়া থেকে নামবার সাহস পাচ্ছে না। সে কী সুভাষ কে ডাকবে একবার? এমন সময় বাইরের দরজার দিক থেকে দমকা এক হাওয়া এসে ঘরের মধ্যে কুণ্ডলীপাক খেতে শুরু করল। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে অনিমিখের। সারা শরীর যেন অবশ লাগছে তার।

(৪)
খাপরী ফুঁড়ে চোখে এসে পড়ছে দিনের প্রথম আলো। জঙ্গলের ভোরের হাওয়ায় এমন এক স্নিগ্ধতা থাকে, শহুরে বাবুদের আরও অলস করে দেয়। তখন চট করে চোখ খুলতে চায় না। কিন্তু কানে এত কোলাহল এসে লাগছে কেন? হাটে, বাজারে, স্টেশনে যেমনটা হয়। বহু মানুষের গলা ভেসে আসছে। সুভাষ, অনিমিখ দুজনেই উঠে বসেছে খাটিয়াতে। সুভাষের কপালের দাগটা কালো নয়, বাদামি। রঙ লেগেছে বোধহয়। ঘরের মধ্যে ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে না। সুভাষ বলল, “মনে হচ্ছে বাইরে কোন গণ্ডগোল বেধেছে। চলুন তো বেরিয়ে দেখি।” সুভাষের সাথে অনিমিখ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
বাইরে রাস্তার উপর বেশ ভিড় জমেছে। সুভাষরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। জটলার মধ্যেখান দেখা যাচ্ছে না, সবাই গোল করে ঘিরে রয়েছে। অনিমিখ ও সুভাষ অনায়াসেই ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে ঢু্কে পড়ল।
এ কি! কি দেখছে অনিমিখ? সুভাষের সাদা রঙের ফোর্ড রাস্তার পাশে উল্টে রয়েছে। কে উল্টে দিয়ে গেল? অদ্ভুত ব্যাপার তো! অনিমিখ এবার চোখ ফেরাল পাশে। এবার চমকে উঠল আরও, সাংঘাতিক রকম!
সুভাষ শুয়ে রয়েছে। ঠিক তার পাশে সে নিজে। তাদের দু’জনের থেকে একটু তফাতে রাতের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তিন জনের নাকে মুখে কপালে শুকিয়ে যাওয়া চাপ চাপ রক্তের ছোপ। ফ্যাকাশে চামড়ার রঙ। শরীর জুড়ে ভনভনিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে মাছি।
অনিমিখ উন্মাদের মত এর ওর হাত টানছে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে ডাকাডাকি করছে। কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, কেউ তাকাচ্ছে না তার দিকে। সবাই নিজেদের মত আফশোস করছে।
এক পুলিশ অফিসার অন্য এক অফিসার কে বলছেন, “গাড়িটা এসে সোজা ধাক্কা মারে ওই লোকটাকে, লোকটি স্থানীয়। লোকটি ছিটকে যায় প্রায় পনেরো ফুট দূরে। ওই যে মোড়ের মাথা পর্যন্ত। ধাক্কা মারার পর বেসামাল হয়ে কয়েক পাল্টি খেয়ে এই পর্যন্ত এসে পড়ে গাড়িটি। রাতের দিকে ঘটেছে বোধহয়। এই দু’জন গাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি। তিন জনেই স্পট।”
অনিমিখ এবার সুভাষের দিকে তাকাল। সুভাষ করুণ চোখে চেয়ে রয়েছে তার দিকে।
সমাপ্ত

1 thought on “জংলী_হাওয়া”

Leave a Comment