শক্তিগড়ের ল্যাংচা খায়নি, এমন বঙ্গবাসীর সংখ্যা খুবই কম। কলকাতা থেকে ৮০ কিমি দূরে শক্তিগড়ে গাড়ি থামিয়ে ল্যাংচা খাওয়াটা বাঙালির একটা কালচার। ইতিহাস বলে বাঙালি আর মিষ্টি তো পরস্পরের সমার্থক শব্দ। তার ওপর হয় যদি শক্তিগড়ের ল্যাংচা, তাহলে তো জিভের জল আটকানোই মুশকিল। এই নরম তুলতুলে,রসে নিমজ্জিত, লাল বা কালচে লাল রঙের মিষ্টি টির ইতিহাসও কিন্তু বেশ মধুর। জেনে নিন তবে ল্যাংচার ইতিহাস।
নারায়ন সান্যালের ‘রূপমঞ্জরী’ উপন্যাসে ল্যাংচা কাহিনীর কিছুটা বর্ননা আমরা পাই। জানা যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দের কন্যার বিবাহ, বর্ধমানের রাজার কোন এক পুত্রের সাথে সম্পন্ন হয়। বিবাহের কিছু বছর পরেই বর্ধমানের রাজার পুত্রবধূ সন্তান-সম্ভবা হয়। কিন্তু তার মুখে তখন কোন খাবারই রুচতোনা। এই নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পরে। একদিন শ্বাশুড়ি মা অর্থাৎ রাজমাতা তাঁর পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করেন- মা তুমি কি খেতে চাও বলো। তখন সেই গর্ভবতী বধূর মুখ ফসকে একটা শব্দ বেরোয়- ল্যাংচা। রাজমাতা বলেন, এ কি বউমা? কোন খাবারের নাম? বউমা লজ্জায় আর কোন কথা বলে না। পরে সে তার স্বামীকে জানায় তার বাপেরবাড়ি অর্থাৎ নদীয়া তে এক ময়রা ছিলেন তিনি খোঁড়া। তিনি একধরনের মিষ্টি বানাতেন তবে তার নাম-রূপ কিছুই মনে নেই। খোঁড়া বলে তাকে সবাই ল্যাংচা বলতো এটুকুই মনে আছে। রাজপুত্র তার পিতামাতা কে সব কথা জানায়। পুত্রবধূর লজ্জা ও সন্মানের কথা ভেবে রাজা গোপনভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে পত্র পাঠান, তিনি যেন সেই ময়রা কে খুঁজে বর্ধমানে পাঠান। অবশেষে রাজা পুত্রবধূর ইচ্ছে পূরণের জন্য সেই ময়রা কে বর্ধমানে আনা হয়। রাজা তাকে বরশূল গ্রামে থাকার জমি-জায়গা ও শক্তিগড়ে দোকান করে দিলেন। তারপর থেকে প্রতিদিন রাজবাড়ীতে এক মন করে সেই বিখ্যাত মিষ্টি সরবারাহ করত খোঁড়া ময়রা। তখন থেকেই সেই মিষ্টির নাম হয়ে গেলো ‘ল্যাংচা’। শোনা যায় লর্ড কার্জন যখন বর্ধমানে এসেছিলেন তখন তাঁকে মিহিদানা, সীতাভোগের সাথে ল্যাংচাও পরিবেশন করা হয়েছিলো।
আজ যখন দূর্গাপুর হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা ১ কিমি ব্যাপি শুধু এই ল্যাংচা দোকান গুলি দেখি তখন একটা জিনিস খুবই দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা হলো দোকানের নাম গুলি। ল্যাংচা মহল, ল্যাংচা কুঠি, ল্যাংচা ঘর, ল্যাংচা প্যালেস, ল্যাংচা নিকেতন আরও কত কি – যার মূল কথা হল ‘ল্যাংচা’। কিছু দোকানের সামনে উত্তম,সুচিত্রা, প্রসেনজিৎ, দেবের আগমনের গল্পও শোনা যায়।
বংশ পরম্পরায় ময়রারা এই ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ময়রার হাতবদল হলেও স্বাদে, গন্ধে, রূপে শক্তিগড়ের ল্যাংচা আজও জগত বিখ্যাত।